পালি ভাষা ও সাহিত্য সাবজেক্ট রিভিউ

জয় বড়ুয়া আবির, ফুয়াদ হাসান

পালি ভাষা হল বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র ও পুরাণের ভাষা। পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। পালি ভাষাটি ত্রিপিটক ও ত্রিপিটক মতন নিকটতম অদ্যাপি সাহিত্যের ভাষা।

ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকp
ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক

একটি প্রাচীন প্রাত্যস্ত ভাষা (সংস্কৃত থেকে প্রাপ্ত) যা ঐশ্বরবাদ বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মতত্ত্বীয় এবং লিটারগাল ভাষা।এটা সহজাত ভাষা এবং মানুষের মূল ভাষা। ভগবান বুদ্ধ স্বয়ং এ ভাষায় কথা বলতেন, আলাপ করতেন এবং উপদেশ দিতেন। পালি ভাষা বৈদিক ভাষার ন্যায় ‘দেবভাষা’ হিসেবেও অভিহিত হয়।

কেউ কেউ পালি ভাষাকে বিভিন্ন অঞ্চল বা জনপদের বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে সৃষ্ট মিশ্রভাষা বা সঙ্কর ভাষা (যুনৎরফ ষধহমঁধমব) বলেছেন।

পালি শাস্ত্রের পরিচয়

কোন কোন পণ্ডিতের মতে পাঠ হতে পালি শব্দের উদ্ভব, পাঠ>পাল>পালি। তাদের মতে গৌতম বুদ্ধ তার শিষ্যদের যে পাঠ বা উপদেশ দিতেন, সেই বুদ্ধবচন হল পালি। কেউ মনে করেন গৌতম বুদ্ধ এর বাণী এই ভাষাতে পালন করা হয়েছে বলে এর নাম পালি। কেউ বলেন মগধ এর প্রাচীন নাম পলাস হতে পালি এসেছে। আবার অনেকে বলেন প্রাচীন মগধ এর রাজধানী পাটলিপুত্র নাম থেকে পালি শব্দ এসেছে। কেউ মনে করেন পঙক্তি হতে পালি শব্দ এস থাকতে পারে।

পালি বর্ণমালা আকখারা মুনি
পালি বর্ণমালা আকখারা মুনি

এটি খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দ থেকে বিভিন্ন ব্রাহ্মী লিপিতে লিখিত হয়ে আসছে। আর সেজন্য প্রাচীন এই ভাষাজ্ঞান আরও বিস্তারিতভাবে লাভের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ভাষার উপর উচ্চ শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১২৯টি সংস্কৃত ও ৯৩টি পালি টোল/কলেজ/চতুষ্পাঠ মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রাচীন পদ্ধতিতে সংস্কৃত ও পালি ভাষা শিক্ষা পাঠদান করা হয়।

বর্তমানে বিভাগটি ‘পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট বিভাগ’ নামে স্বতন্ত্রভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।বাংলাদেশের আরো দুটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় চবি ও ঢাবিসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রায় দুইশতাধিক কলেজ রয়েছে যেখানে পালি ও সংস্কৃত ভাষা বিষয়টি পড়ানো হয়।

বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি বিভাগে চার বছর মেয়াদি স্নাতক ও এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর তথা মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়াও, এম. ফিল ও পিএইচ. ডি গবেষণা কার্যক্রমও চালু আছে। বর্তমানে কলা ও মানব বিদ্যা ভবনের ২য় তলায় বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের পাশে পালি ও প্রাচ্য ভাষা বিভাগটির শিক্ষা ও দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

পালি ভাষা ও সাহিত্য কেন পড়বো

পালি ভাষা ও সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েটদের অন্যদের মতন উচ্চ শিক্ষায় উন্নত হওয়ায় এবং নতুন আঙ্গিকে চিন্তা করার শক্তি থাকায় তাঁরা বিভিন্ন বিশেষায়িত সেক্টরে; যেমন লেখালেখি, নানা সৃষ্টিশীল কর্মক্ষেত্র, সাংবাদিকতায় সৃজনশীলতার সাথে বিচরণ করতে পারেন। যেহেতু পালি ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে ভাল ধারণা ও জ্ঞান পাওয়া যায়। যা আমাদের সৃজনশীলতা ও কাব্যিক শৈল্পিকতা বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লেখালেখির মান আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

বিনয় পিটক (মহাবর্গ)
বিনয় পিটক (মহাবর্গ)

জগৎ, জীবন, আধুনিক মানুষের সমাজব্যবস্থা , তাদের সামাজিক চেতনা এবং জ্ঞানের প্রক্রিয়া, ধর্মীয় আচার ব্যবহার, বৌদ্ধ ধর্মীয় চেতনার সাথে বাস্তবের আধুনিক জীবনের মিল, ধর্মীয় দর্শনের সাথে আনুষাঙ্গিক দর্শনের মিল ও ভুল বের করে তা সংশোধনের মাধ্যমে মত পোষণ, সামাজিক নৈতিক করণীয় বিষয় সমুহ প্রভৃতি আলোচনাকে সাথে নিয়ে পালি ও বুডিস্ট স্টাডিজ এর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত। পালি ও বুডিস্ট স্টাডিজ এর অধ্যয়ন রত শিক্ষার্থীরা স্পষ্টভাবে লিখতে এবং নিজ সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে নতুন নৈতিক কিছু সৃষ্টি করতে পারে। তাঁরা আধুনিক জীবনের সাথে ধর্মীয় যুক্তি গঠন ও তা জীবনে প্রয়োগ করতে শিখেন, যার ফলে তারা অন্যান্য মানুষ মতই অধিক দক্ষতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। মূল কথা পালি ও বুডিস্ট স্টাডিজ এর মূল উদ্দেশ্য মানুষকে নৈতিকতা শেখানো। বৌদ্ধ দর্শন অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠতে পারে।
এগুলো তাঁদেরকে ভবিষ্যতে চাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে; অর্থাৎ সামগ্রিক জীবন যাপনে অনেক ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখে।

পালি ভাষা ও সাহিত্যে কি কি কোর্স পড়ানো হয়

ডিগ্রির মানBA
কোর্সঅনার্স,মাস্টার্স,এমফিল,পিএইচডি
মেয়াদ৪ বছর (অনার্স) (তবে সেমিস্টার/ইয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী)

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ৪ বছর মেয়াদে বিভিন্ন কোর্স পড়ানো হয়। এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের পালি ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরেজী, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, কম্পিউটার সাইন্স শিক্ষা, বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃত অধ্যয়নসহ আরো অন্য কোর্সসমূহ পড়ানো হয়।
পালি ডিপার্টমেন্ট এর পড়ানো কোর্সসমূহ-

প্রথম বর্ষের কোর্স

Life and Basic Teaching of Buddha

Grammar and Translation

Pali Sutta Pitak

Pali Prose Texts

Allied (1) Sociology

Allied (2) Computer Science or Sanskrit

language and literature

Compulsory English

দ্বিতীয় বর্ষের কোর্স

Pali Poetical Texts

Vinay Pitaka

Pali Philosophical Texts

Pali Canonical Prose Texts

Allied (3) History of Ancient India

Allied (4) Indian Philosophy or Bangla Language and Literature

পালির কিছু পাঠ্য বই
পালির কিছু পাঠ্য বই

তৃতীয় বর্ষের কোর্স

Pali Commentaries

Buddhist Sanskrit Literature

Comparative Philosophy and Linguistic

Pali Prosody, Rhetoric and Grammer

Non-Canonical Pali Literature

Jakata- Apadama Literature and Fables

Pali Vamsa Literature

Introduction Of Theravada Buddhist Philosophy

চতুর্থ বর্ষের কোর্স

History of Buddhism in South East And North East Asia

History of Buddhism and Buddhist Culture in Bangladesh

Social Life and Buddhism

Introduction to Mahayana Buddhist Texts and Philosophy

Introduction to AbhidhammPhilosophy

Discourses of Suttspitaka

Theravada and Mahayana Buddhist Philosophy

Political and Religious History of Buddhism in Ancient India

পালি ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ

কিছু কিছু শিক্ষার্থী পালি সাহিত্যের উপর স্নাতক স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি স্তরে দর্শনের পড়াশোনা করেন। প্রভাষক হিসাবে পেশা অর্জনের উদ্দেশ্য বা কেবল তাদের বিষয় বা তাদের উভয়ের ভালবাসার কারণে এটি হতে পারে।এই বিষয়ের উপর উচ্চতর জ্ঞান গুলো অর্জন করার জন্য।

বুদ্ধদেবের অবয়ব
বুদ্ধদেবের অবয়ব

স্নাতক সম্মান এর পর অন্যান্য আগ্রহের ক্ষেত্রগুলি মানে স্নাতকোত্তর এর জন্য যে বিষয়গুলির উপর স্নাতকোত্তর করার মধ্যম রয়েছে রাজনীতিক বিজ্ঞান , নীতিশাস্ত্র, বাংলা সাহিত্য , ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং সমাজবিজ্ঞানসহ অন্যান্য।আমাদের বাংলা ভাষার প্রায় সিংহভাগ শব্দ এসেছে পালি সাহিত্য থেকে। যেহুতু পালি, মাগধি প্রাকৃত ও সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। আমাদের দেশের অনেক মানুষ সাহিত্য বোঝে না কারণ তারা সাহিত্যের ভাষা বোঝে না তার অন্যতম কারণ প্রাচীন বাংলার সাহিত্যের সাথে পালি, প্রাকৃত ও সংস্কৃতের যোগসুত্র। যারা পালি, ও সংস্কৃত সাহিত্য ভাষা বোঝে না তারা অনেক প্রখ্যাত লেখকদের লেখনী বোঝে না। অর্থাৎ বাঙালি হিসেবে পালি ও সংস্কৃত জানাটা একান্ত কাম্য আর সেখানে যদি এই বিষয়ের উপর উচ্চ শিক্ষা নেওয়া যায় তাহলে কেন পড়বেন না? পালি ও সংস্কৃত সাহিত্য চর্চা করলে বাংলা ব্যকরণের অনেক খুঁটিনাটি বিস্তারিত পাওয়া যায়। প্রাচীন সমাজ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারবেন।

আবার আমরা যেহেতু বাংলা ভাষাভাষী আমাদের ভাষার পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জানতে পারাটাও একটা সুযোগই বলা চলে। সাথে ইংরেজি, বাংলা, সমাজবিজ্ঞান, কম্পিউটার শিক্ষা, দর্শন, প্রাচীন ইতিহাস, ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সুযোগ তো থাকছেই।

প্রতি বছর পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পালি ভাসা ও সাহিত্যের উপর প্রচুর স্কলারশিপ দেওয়া হয়।
তাই দেশে ও বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে কোনো সমস্যা নেই। প্রতিবছর বিভিন্ন সময়ে, পূর্ব এশিয়া, ( চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম), ইউরোপ ও আমেরিকা( জার্মানি, কানাডা,), মধ্যপ্রাচ্য(তুরস্ক,) ও নানা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য স্কলারশিপ তো আসেই। একটু ভাল করে পড়লেই সেখানে পড়তে ও কর্মক্ষেত্র বেছে নেবার কোন চিন্তায় নেই।

পালি ভাষা ও সাহিত্যে ক্যারিয়ার

লেখক, গবেষক, Analitical Research Analyst, সাংবাদিক, NGO কর্মী, থেকে শুরু করে Multinational Company, Private Firm সহ অনেক জায়গাই পালি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত।

একজন পালি ভাষা ও সাহিত্য গ্র্যাজুয়েট যদি যোগ্যতা রাখেন, তাহলে তিনি উপরোক্ত যেকোনো ক্ষেত্রে একটি সফল ক্যারিয়ার গড়তে পারবেন। এছাড়াও তাঁরা অন্যদের মতো বিসিএস ও ব্যাংক জবস্ পরীক্ষার মাধ্যমে একজন বিসিএস ক্যাডার এবং ব্যাংক উচ্চপদের কর্মকর্তা হতে পারবেন। আর শিক্ষা ক্যাডারে আলাদা করে সুযোগ তো থাকছেই। কলেজগুলোতে শিক্ষা ক্যাডার হয়ে শিক্ষক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারও গড়া সম্ভব এখানে।ক্যারিয়ারের দৌড়ে আপনি যতটা স্মার্ট হবেন ততই এগিয়ে থাকবেন তবুও বিভিন্ন প্রতিযোগিতা মূলক চাকরী পরীক্ষায় অন্যদের চেয়ে আপনি একটু এগিয়েই থাকবেন পালি সাহিত্য বিষয়টি অধ্যয়নের কারণে। বিশেষ করে বাংলার ক্ষেত্রে একটা আলাদা সুবিধাতো আপনি পাবেনই।

এছাড়াও যেকোনো সরকারী, বেসরকারী চাকুরীতেও আপনি যোগদান করতে পারবেন পালি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক সম্মান সম্পন্ন করে। এছাড়া পালি সাহিত্যের উপর স্নাতক সম্মান এর পাশাপাশি নানা রকম বিষয়ে কোর্স করে বিশেষ বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ডে কোর্স করে একজন সফল উদ্যোক্তা হবার ও সুযোগ রয়েছে। এছাড়া নানা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা অংশগ্রহণ করে শিক্ষকতা পেশাকে আপন করে নেবার পথ তো সর্বদায় খোলা আছেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *