হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী : নেতাদের সেকাল ও একাল

মোঃ আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। পরে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলা হয় তাঁকে। তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি পালন করেছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সামলেছেন অনেক পদ। ১৯২৪ সালে কলকাতা করপোরেশনের ডেপুটি মেয়র, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনোত্তর ফজলুল হক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার শ্রম ও বাণিজ্যমন্ত্রী, ১৯৪৩-৪৫ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী, ১৯৪৬-৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪-৫৫ সালে মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী এবং পরে ১৩ মাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তো সামলেছেনই। গিয়েছেন রাজনৈতিক উত্থান পতনের মধ্য দিয়েও। ছিলেন নেতাদেরও নেতা।তৈরী করেছেন নিজের হাতে অজস্র নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কিংবদন্তি নেতাও তার পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেকে বিকশিত করেছেন।উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ও সুপরিচিত এই নেতার ১২৭তম জন্মবার্ষিকী আজ ৮ সেপ্টেম্বর।

আজকের তুলনামূলক আলোচনাটা করতে চাই নেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব কেমন ছিলেন বর্তমান আমাদের সময়কার নেতাদের সাথে মিলালে সেই ব্যাপারে। ভাতের হাঁড়ির একটি ভাত চাপ দিলেই যেমন পুরো হাঁড়ির অবস্থা বোঝা যায়- তেমনি কর্মীদের সাথে নেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব কেমন ছিলেন তা বুঝতে তার তারকা শিষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের আত্মজীবনীতে আর স্মৃতিকথায় তার ও সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলেই ধারণা পাওয়া সম্ভব। কেননা বঙ্গবন্ধুর এ আত্মকথন এখন আমাদের ইতিহাসের একটু গুরুত্বপূর্ণ দলিলও বটে।

নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনে যাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম মুখ্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই প্রভাব বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সাথে আমার পরিচয় হলো, কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।’ কথাগুলোর মধ্যেই প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন আবেগ ও শ্রদ্ধার জায়গাগুলি। বঙ্গবন্ধুকে পাকা জহুরির মতো খুঁজে তুলে আনাটা নেতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের একটি বড় গুণ নিঃসন্দেহে। ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জে সভায় এসেছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক আর শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধু তখন কেবল স্কুলছাত্র ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীটা বঙ্গবন্ধুই প্রস্তুত করেছিলেন। সভা শেষে যখন মিশন স্কুল দেখতে গেলেন সোহরাওয়ার্দী তখন ওই স্কুলেরই ছাত্র বিধায় তাঁকে সংবর্ধনার নেতৃত্বও বঙ্গবন্ধুই দেন। পরে হাঁটতে হাঁটতে সোহরাওয়ার্দীকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দেবার সময়ই সোহরাওয়ার্দী সাহেব চিনতে পেরেছিলেন রত্ন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন। নাম কী, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি নোটবুক বের করে টুকেও নেয়েছিলেন তিনি সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধুকে কলকাতায় গিয়ে দেখা করতে বলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুও চিঠির উত্তর দেন। পরে কলকাতায় যখন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে দেখা করতে যান বঙ্গবন্ধু তখন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পরামর্শেই কলকাতায় ভর্তি হন তিনি এবং অভিষেক ঘটান তার রাজনৈতিক জীবনের। এ জায়গাতেই আমরা বুঝতে পারি নেতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী সাহেব কতখানি প্রখর ছিলেন কিভাবে নেতৃত্ব তুলে আনতে জানতেন তিনি।

নেতা হিসেবে শাসন ও স্নেহ দুটির কোনোদিকই কমতি রাখেন নি সোহরাওয়ার্দী সাহেব। একবার বঙ্গবন্ধুকে বকাঝকা করবার পর ডেকে নিয়ে আদর করে দিয়েছিলেন তিনি৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষায় বলেন, ‘তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি যে সত্যিই আমাকে ভালোবাসতেন ও স্নেহ করতেন, তার প্রমাণ আমি পেয়েছি তাঁর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার দিন পর্যন্ত। সেই দিন থেকে আমার জীবনে প্রত্যেকটা দিনই তাঁর স্নেহ পেয়েছি। এই দীর্ঘদিন আমাকে তাঁর কাছ থেকে কেউই ছিনিয়ে নিতে পারে নাই এবং তাঁর স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই।’ নেতা হিসেবে নিজের কর্মীকে কতখানি ভালোবাসতেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব তা আরো কিছু কাহিনীতে স্পষ্টতর হয়। একবার নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী পার্টি গঠন বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরামর্শ করতে বঙ্গবন্ধুকে লাহোর পাঠান ভাসানী। বঙ্গবন্ধু গিয়েই জানতে পারেন শহীদ সাহেব লাহোরে নেই। পকেটে মাত্র দুই টাকা। কনকনে শীতে গরম কাপড়ও নেই। উপায়ান্তর না দেখে পূর্বপরিচিত মিয়া ইফতিখার উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। কোনো রকম দুটি দিন পার করার পর সোহরাওয়ার্দী এলেন। নবাব মামদোতের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে দেখেই উঠে জড়িয়ে ধরলেন। খোঁজখবর নিলেন, ‘তোমার শরীর দেখি খুব খারাপ, কোথায় আছ?’ বাকিদের বিদায় দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পড়লেন। কলকাতা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে আসায় নিজের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর জন্য নিজের খরচে হোটেল ঠিক করে দিলেন। এরপর নিজের জন্য জামা-কাপড় কেনার কথা বলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেলেন দোকানে। মোজা, মাফলার, কম্বল, সোয়েটার সব কিনলেন। বঙ্গবন্ধুকে হোটেলে নামিয়ে দেওয়ার সময় তাঁর হাতে কাপড়গুলো ধরিয়ে দিলেন সোহরাওয়ার্দী। কেনাকাটা যে তাঁরই জন্য, আগেই সেটা জানিয়ে তরুণ বঙ্গবন্ধুকে বিব্রত করতে চাননি সোহরাওয়ার্দী সাহেব।

এমনকি বঙ্গবন্ধুর সংসারের আয়-রোজগার নিয়েও ভাবতেন সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৭-য় প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগেই বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান চা বোর্ডের সভাপতি করেন তিনি। এটি ছিল এমন একটি কাজ, যাতে সম্মানী আছে; কিন্তু তেমন কোনো কাজ নেই। কেননা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এতবড় দায়িত্ব পালনের পর অন্য কোনো কাজ করাটা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু টাকা তো তাঁর প্রয়োজন। রাজনীতির বাইরেও স্ত্রী, চারটি সন্তান নিয়ে একটা পরিবার ও তো সামলাতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। পার্টির কাজে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত এই মানুষটার সংসার তাহলে চলবে কী করে। আর তাই বঙ্গবন্ধুকে আলংকারিক এই কাজটা জুটিয়ে দিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী।

এভাবেই নিজের কর্মীর ভালোমন্দ, তার স্টাবলিশমেন্ট, এমনকি পারিবারিক খোঁজ খবর ও রেখেছেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব। আর সেজন্যই কর্মীর থেকে খাঁটি ভালোবাসাও পেয়েছেন তিনি। তার দুর্দিনেও তার কর্মীরা ভোলেনি তাকে।
বঙ্গবন্ধু তার একটি লেখায় লিখেছেন, ‘জীবনের বহুদিন তার সাথে সাথে ঘুরছি। তার স্নেহ পেয়েছি এবং তার নেতৃত্বে বাংলার লোক পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। যার একটা ইঙ্গিতে হাজার হাজার লোক জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করত না, আজ তার কিছুই নাই। মামলা না করলে তার খাওয়ার পয়সা জুটছে না। কত অসহায় তিনি! তার সহকর্মীরা- যারা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করত, তারা আজ তাকে শত্রু ভাবছে। কত দিনে আবার দেখা হয় কী করে বলব? তবে একটা ভরসা নিয়ে চলেছি, নেতার নেতৃত্ব আবার পাব। তিনি নীরবে অত্যাচার সহ্য করবেন না, নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবেন। পূর্ব বাংলায় আমরা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে পারব এবং মুসলিম লীগের স্থান পূর্ব বাংলায় থাকবে না, যদি একবার তিনি আমাদের সাহায্য করেন। তার সাংগঠনিক শক্তি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব জাতি আবার পাবে।’
একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় কতখানি ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রকাশ রয়েছে এখানে।

এই পুরো কাহিনীগুলো বলার কারণ হলো একজন নেতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী সাহেব কেমন ছিলেন তার একটি চিত্রায়ণ সৃষ্টি করা। এমন নেতার জন্য কোন কর্মীর ই সম্মান ভেতর থেকে সৃষ্টি হবে না বলুন। বিপরীতে আজকের নেতাদের কথা আমরা একটু ভাবতে পারি। কোনো রকম আলোচনা করবার প্রয়োজন নেই, তাদের কথা মাথায় আসলেই আমরা বুঝি পার্থক্য কতখানি গভীর। আমাদের হাল ফ্যাশনের নেতাদের নিয়ে কর্মীদের নানাবিধ হতাশা। নেতারা কর্মীদের খোঁজ রাখেন না, যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাদের পাওয়া যায় না, নেতাদের কোনো বিষয়ে মতামত দেয়া যায় না। সার্বিকভাবে বলা যায় নেতার সাথে কর্মীর একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে। এজন্য রাজনীতিটাও দেনাপাওনা কেন্দ্রীক হয়ে যাচ্ছে। একটা সাংগঠনিক পরিচয়ের জন্যই শুধু নেতাকে প্রটোকল দেবার প্রবণতা বাড়ছে- বা কিছু সুবিধা পাবার আশায়। ফলশ্রুতিতে একটা আই হেইট পলিটিক্স জেনারেশনের সৃষ্টি হচ্ছে। নেতা ও কর্মী উভয়েরই একে অপরের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। এটা যেন আমরা ভুলে না যাই। এ বাংলার বুকে আরো সোহরাওয়ার্দী-মুজিব এর মতো গুরু শিষ্য ফিরে আসুক।

 

লেখক-

সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

abdullahaljobayercu@gmail.com

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *