‘আই হেইট পলিটিক্স’ এর মহিমান্বিতকরণে অনুতপ্ত

মোঃ আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের

প্রথম আলো পত্রিকায় মতামত পাতায় জনাব হেলাল মহিউদ্দিন সাহেবের একটি কলাম পড়লাম ‘আই হেইট পলিটিকস’ প্রজন্মই আসল ভরসা – এই শিরোনামে। ভদ্রলোক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি বিষয়ে পড়ান; নিঃসন্দেহে জ্ঞানী ব্যক্তি। কিন্তু তার এ কলামের যুক্তিযুক্ত সমালোচনা করা আমার নৈতিক দায়িত্ব বলে বোধ করায় করতে হচ্ছে। কেননা প্রথম আলোর মতো একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় প্রকাশিত হবার কারণে তার এ লেখাটি নিঃসন্দেহে অনেক বেশি পাঠক পাবে এবং একটি জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। সেই জনমত একপাক্ষিক হয়ে গড়ে ওঠার কারণে আমার মতে হয়ে উঠবে খু্বই একপেশে এবং কিশোর ও তরুণদের উপর এর বায়াস প্রভাব কখনোই মঙ্গলজনক হবেনা বলে আমি মনে করি।

লেখার শুরুর দিকে তিনি এই ‘আই হেইট পলিটিক্স’ প্রজন্ম দেখতে কেমন তার চরিত্রায়ন করবার চেষ্টা করেছেন। আমি আমার লেখায় এদের একটি গোষ্ঠী বলে সম্বোধন করবো কেননা তারা একটি প্রজন্মর প্রতিনিধিত্ব কখনোই করেন না। তিনি বোঝাবার চেষ্টা করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ গোষ্ঠী নিজেদের এ মনোভাব জানান দিয়ে থাকেন। এবং তাদের নিয়ে পুরোনো দিনের, মধ্যবয়সী ও পড়তি বয়সী রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মানুষেরাই বেশি অভিযোগ করেন বলে লেখকের ধারণা। অভিযোগগুলোর সারমর্ম হলো তারা ভিতু ও আত্মকেন্দ্রিক ধরনের। লেখক এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দাবি করেছেন এ কিশোর-তরুণেরা আসলে সাহসী এবং সচেতন। নতুবা সড়ক আন্দোলনে এত হিম্মত, এত সাহস এদের মধ্যে কোথা থেকে এলো। এই ঘটনাকে নমুনায়ন ধরে এত দ্রুত ফলাফলে পৌঁছে যাওয়াতে আমার আপত্তি আছে৷ ফলাফলে পৌঁছাবার আগে আমাদের বিবেচনা করতে হবে আমাদের জাতিগত স্বরূপ, বয়সের প্রবৃত্তি, সামাজিকীকরণ প্রভৃতি বিষয়।

আসুন প্রথমে বাঙালী জাতিগত স্বরূপটা একটু চিন্তা করি কেমন। কোনো একটা ইস্যু নিয়ে স্বরব হওয়ার এবং এটাকে নিয়ে নানাবিধ এক্সপেরিমেন্টের ক্রেজটা আমাদের ভেতর খুবই স্বাভাবিক। প্রথম আলোতেই ২০২০ সালের ২০এ এপ্রিল একটি কলাম প্রকাশিত হয়- ‘বাঙালী, জাতি হিসেবে যেমন’ এই শিরোনামে। লেখিকা সেখানে বলেছেন, আমরা জাতি হিসেবে আবেগী৷ আসলে এটি অত্যন্ত সত্য বিষয়। করোনা পরিস্থিতি যদি একটু পর্যালোচনা করা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাবো, প্রথমে মানুষ জাদুঘরের কোনো অবাক করা বস্তু দেখবার মতো করোনা আক্রান্ত রোগী দেখতে ভিড় করেছিলো বিমানবন্দরে। কিছুদিন পর যখন করোনা ছড়িয়ে পড়া শুরু করলো সরকার এবং মিডিয়া সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো নাগরিকদের সচেতন করবার জন্য, কিছুদিন সবাই খুবই সচেতন, অতিরিক্ত আতঙ্ক পেয়ে বসলো সবাইকে। সুতরাং যতটুকু করা দরকার তার চেয়ে অতিরিক্ত করা শুরু করলেন সবাই। কিছুদিন পর যা তাই! এই অবস্থা প্রমাণ করে, এই ক্রেজ খুবই সাময়িক। এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে তা হবে বিরাট সময়সাপেক্ষ ব্যাপার৷ দ্বিতীয় ব্যাপার, আমাদের মনস্তত্ত্ব বিদ্রোহকে খুব ভালোবাসে৷ এর সাথে খানিকটা গুজব যুক্ত হলে সাময়িক জোশ প্রাপ্তিও সম্ভব হয়।

তা আরো কার্যকরী হয় বয়সে আনুপাতিক হারে ছোটদের ক্ষেত্রে। কৈশোরে পাহাড় দাবানোর স্বপ্ন উস্কে দেয়া যত সহজ, তা বাস্তবায়নের রাস্তা দেখানো ততই কঠিন। এবং আমাদের সামাজিকীকরণে স্বপ্নের পথে লড়াই করার সঠিক পন্থার প্রচেষ্টার জায়গাটুকু ঝাপসা। জনাব হেলাল মহিউদ্দিন সাহেব যে এই ‘আই হেইট পলিটিক্স’ গোষ্ঠীর ভেতর আশা দেখতে পাচ্ছেন সেখানে কিভাবে আমি কোনো আশার সুযোগ দেখিনা তা পরিষ্কার করি এবার। এই প্রজন্ম যেহেতু বয়সে কিশোর এবং বয়সটিতে যেহেতু চ্যালেঞ্জ নেবার নেশায় পেয়ে বসে তাই তারা রিফর্মেশন হোক বা যাই হোক বদলাবার স্বপ্ন দেখে ফেলে। কিন্তু এ বদলের প্রসেসটা তারা ভুলে যায় বা এড়িয়ে যায়। আদতে এ বদলানোর রাস্তাই হলো রাজনীতি এ রাস্তাই হলো কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ৷ কিন্তু তাদের এ রাস্তায় না যাবার পেছনের কারণ হলো তারা শুনে আসছে দেখে আসছে রাজনীতির কলুষিত একটা দিক যা সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিতে যোগ্য মানুষের অংশগ্রহণের অভাবে। কিন্তু কেন রাজনীতির এ অবস্থা তা তার কাছে মুখ্য নয় এটিই হলো সমস্যা। এ বিষয় বুঝবার এবং চর্চার ধারেকাছে যাবার থেকে আই হেইট পলিটিক্স এই কনক্লুশনে যাওয়া এবং হুজুগে আন্দোলন করা অনেক বেশি সহজ!
কিন্তু এটিও যে একপ্রকারের রাজনৈতিক কর্মকান্ড তা হয়তো তারা জানেনা!

বিকল্প রাস্তা বিপ্লবের নেশায় বুদ জনতা আন্দোলন করে রিফর্মেশনের স্বপ্ন দেখে ফেলে কিন্তু তা কি উপায়ে সম্ভব হবে তা তারা নিজেরাও জানেনা, ঠিক এটিই হচ্ছে রাজনীতির মাঠে সরকারবিরোধীদের সঠিক সুযোগ। তারা এই আন্দোলনকে পুঁজি করবার সুযোগ পায়, এটিকে কাজে লাগায়। আন্দোলনটাতে মিশে যায়, প্রভাবিত করবার চেষ্টা করে তাদের রাস্তায়৷ প্রমাণ কিছুদিন আগের সড়ক আন্দোলনে একটি দলের দপ্তর সম্পাদক মিশে গিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব তার দিকে পরিচালিত করা। এখন আপনারা প্রশ্ন তুলতে পারেন কোনো দলের কর্মী কি আন্দোলনের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারবে না, নেতৃত্ব দিতে পারবে না এ কথা কোথাও বলা আছে নাকি?! অবশ্যই কোথাও বলা নেই কিন্তু অন্যের সৃষ্টিকে নিজের সুবিধার জন্য ভোগ করা যেমন অনৈতিক তেমনি একটি গোষ্ঠীর দাবিকে নিজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রভাবিত করাও নৈতিক নয়। এর যে ফলাফল তা হলো ঐ তরুণদের কিছুদিন পর ঘুম ভাঙে, তারা বোধ করতে পারে তারা ব্যবহৃত হয়েছে এবং আদতে সবই রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অংশ এবং আদিগুরু যে বলেছিলেন- মানুষ পুরোদস্তুর রাজনৈতিক জীব এ কথাও সত্য। তখনই তাদের আই হেইট পলিটিক্স মতবাদটা আরো পোক্ত হয়। সুতরাং নিঃসন্দেহে এই গোষ্ঠীকে নিয়ে আশা দেখবার মতো কোনো জায়গা আমি খুঁজে পাই না। এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে। পরিবর্তনকামী বা রিফর্মেশনের জন্য যারা আওয়াজ তোলে তারা সবাই যে আই হেইট পলিটিক্স গোষ্ঠীর অন্তর্গত তাও কিন্তু না। রাজনীতি সচেতন অনেক মানুষ কথা বলেন এবং ভালো ব্যাপার এটিই তারা জানেন তারা কোন দাবিটি কোন কারণে তুলছেন এবং তারা এ দ্বারা কি অর্জন করতে চান।

আমি নিজেও যেহেতু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং আই হেইট পলিটিক্স গোষ্ঠীর মানুষদের সাথে ওঠাবসার সুযোগ পেয়েছি। আমি দেখেছি তাদের একটি বড় অংশই এ দেশে থাকতে চান না। তারা বিদেশে চলে যেতে চান। কেন চলে যেতে চায়?
একটি উন্নত জীবনযাপনের জন্য তারা এ দেশ ছাড়তে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায় তারা যে উন্নত দেশে যাচ্ছে সেটিও ঐ দেশের কোনো না কোনো জেনারেশনের ঘাম ও রক্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। যে কোনো দেশ, যে কোনো জাতি ত্যাগ ছাড়া এমন পর্যায়ে যেতে পারেনি এবং পারবেও না। উন্নয়নের পথে উঠতি একটা দেশকে ফেলে যে বা যারা আই হেইট পলিটিক্স কারণ রাজনীতি নোংরা, সমাজব্যবস্থা ঘুণে ধরা, সিকিউরিটি নেই বলে পালায় তাদের মধ্যে নেই কোনো সম্ভাবনা, এই গোষ্ঠী কেবলই দেশের বোঝা। দেশের কৃষকের টাকায় গরীবের টাকায় পড়বে, নিজের মেধা কন্ট্রিবিউট করবে অন্য কোনো দেশকে।

সুতরাং প্রিমাইজে ভুল ধারণা রয়েছে। মনে রাখতে হবে যারা মেরামতে নামে তারা সবাই ‘আই হেইট পলিটিক্স’ গোষ্ঠীর নন, আদতে এই গোষ্ঠী আকৃতিতে বেশ ক্ষুদ্র। তাছাড়া, আই হেইট পলিটিক্স বলতে যে তারা পলিটিক্সের নোংরামিকে ঘৃণা করেন এটি বোঝান বলে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন এটিও এটি ভুল ধারণা। চলতি রাজনীতি’, বা ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ বা ‘দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি’ লিখলে যে কথাটা জমতো না এটাও ভুল কথা। কেননা দেশের কোনো সমস্যা হলে আপনি কখনো বলবেন না – আমি দেশকে ঘৃণা করি৷
এটি হবে দেশদ্রোহীতার সামিল। যারা ইতিহাস দেখেছে, বায়ান্ন পড়েছে, উনসত্তর জেনেছে, একাত্তর জেনেছে তারা কখনো বলতে পারেনা আই হেইট পলিটিক্স। যার নূন্যতম বোধ আছে সে মুখরোচক করতে গিয়ে টার্মটাকে অসম্মান করে ফেলবে না। অতএব এ কাজটি তারাই করে যারা প্রকৃতপক্ষেই রাজনৈতিক ভাবে অসচেতন। মনে রাখতে হবে ইন্টারনেটের রিসোর্স অ্যাভেলেবল থাকার মানেই যে আমি এটা নিয়ে ওয়াকিবহাল তা নয়, বরঞ্চ এটা নির্ভর করে আমার চর্চা করবার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর।

সমস্যার উৎপত্তিস্থল খুঁজে বের করা যেমন জরুরী, টু দি পয়েন্টে কথা বলাও তেমন জরুরী। যে রাজনীতির নোংরা পাশকে ঘৃণা করে সে সোজাসাপ্টা বলুক, আমি নোংরা রাজনীতিকে ঘৃণা করি। দুর্নীতি পরিষ্কারের লড়াই পতাকা আগুনে পুড়িয়ে শুরু হয়না, পতাকা ধুয়ে শুরু করতে হয়।

লেখক-

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *