বুদ্ধিজীবী দিবস, বাঙালির রুচিশীলতা ও অন্যান্য

এত স্মার্ট আর ক্ল্যাসি একটা জাতি থেকে হঠাৎ এত ক্ষ্যাত জাতি কিভাবে হয়ে গেলাম আমরা?

এরকম শিরোনামে প্রায়শই আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ভিডিও ক্লিপস অথবা ছবি ঘুরে। সেখানে আমরা অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করি; বলি, আসলেই আমাদের রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। আশির দশক নব্বইর দশকে মানুষ অনেক রুচিশীল ছিলো শিক্ষার আক্ষরিকতার বিকাশ ছিলো ইত্যাদি। কিন্তু কেন আজকের আমাদের এই অধঃপতন, রুচিশীলতার ঘাটতি, শিক্ষার উদ্দেশ্য কেন জ্ঞান থেকে সরে চাকরির দিকে চলে গেছে এগুলো ভাবতে চাই না বা পারি না কিংবা আমাদের সময় নেই।

আজ যদি আমরা একটু ভাবতে যাই আমাদের আগে ভাবতে হবে একটা জাতি কিসের উপরে দাঁড়িয়ে বিকশিত হয়। উত্তরটা হচ্ছে তার মেধা। আমরা সুমেরীয় সভ্যতা বলি বা মেসোপটেমীয় সভ্যতা বলি অথবা কোনো নির্দিষ্ট জাতির উত্থানের গল্পই বলি না কেন, দেখা যাবে সেই উন্নতির পেছনে ছিলো তাদের যুগান্তকারী কিছু আবিষ্কার বা কিছু আইডিয়া-পরিকল্পনা । আর এই আইডিয়া আসে মেধা থেকে। সেই মেধাই উৎপন্ন করে শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আইন কিংবা হোকনা একটা মতামত। এদের আমরা বুদ্ধিজীবী বলি।

৫২-৭১’ এর সময়ে এ বাংলা পেয়েছিল এমন কিছু মেধা, কিছু বুদ্ধিজীবী। যাদের এ প্রকৃতি-পরিবেশ বানিয়েছিলো সাহসী, রুচিশীল।
আমরা দেখেছি সেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের শিরদাঁড়া ছিলো- অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারবার, ছাত্রদের নৈতিক জ্ঞান দিতে পারবার, তাদের অধিকার বুঝিয়ে দিতে পারবার।
তখনকার আইনজীবীদের কাজ শুধু আদালতে দৌড়াদৌড়ি ছিলো না, প্রত্যক্ষও পরোক্ষভাবে আমজনতার সাথে দাঁড়ানো, সমাজের নৈতিক পরিবর্তনে কথা বলা এগুলোও তারা করতেন। তখনকার সাংবাদিকরা কলম হাতে নিতেন আরো ভালো করে অসংগতি তুলে ধরবার জন্য,
জহির রায়হানের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা উপহার দিতেন মাস্টারপিস কাজ ছবি, লেখা।

তখন আমাদের সাহস ছিলো, রুচি ছিলো, মনন ছিলো দেশের জন্য কিছু করবার। দেশটার স্বাধীনতায় যতখানি কৃতিত্ব ঐ মুক্তিযোদ্ধাদের, ঠিক তখনখানি এই বুদ্ধিজীবীদের। এই মানুষগুলো বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আমাদের সংগ্রামটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, আন্তর্জাতিকভাবে জনসমর্থন আদায় করেছে, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। এই মানুষগুলো যদি আরেকটুখানি বুদ্ধির চর্চা করতে পারতো, স্বাধীনদেশে স্বাধীনভাবে যদি ভাবতে পারতো তাহলে আমাদের দেশটা অনেক আগেই আরো দৃঢ় অবস্থানে চলে আসতে পারতো। এটা ঐ তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাশাসকরাও বুঝতে পারে। তাইতো যখন আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত, ঠিক তখনই ১৪ তারিখের রাতে এসে দরজায়-

ঠক, ঠক, ঠক
-কে?
-স্যার বাইরে আসুন। কথা আছে!

৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২জন আইনজীবী ১৬ জন অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) কে হারাই আমরা। আমরা হারাই- ড. মুনীর চৌধুরী, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. আনোয়ার পাশা, শহীদুল্লাহ্ কায়সার, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রণদাপ্রসাদ সাহা, জহির রায়হান এর মতো মেধার কারিগরদের। যারা এ দেশকে হয়তো এগিয়ে নিয়ে যেতো আরো একশো বছর সামনে।

হানাদাররা পরাজয় নিশ্চিত জেনেই এ জাতিকে শেষবার প্রবল আঘাতের জন্যই, মেধাশূণ্য করে দেবার জন্যই এ হত্যাকান্ড চালায়, মহাত্মাদের ঠাঁই হয় গণকবরে, নয়তো শকুনের পেটে। কিভাবে আমাদের এই অধঃপতন? এইতো, নিঃসন্দেহে এভাবেই। যখন একটা জাতির মাথাগুলোকে ফেলে দেয়া হয় তখন তার মনস্তাত্ত্বিক, অবকাঠামোগত বিরাট উন্নয়ন কিভাবে হবে? হয়নি, আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি সেই ক্ষতি। শিক্ষা আর তার আসল কাজ পূরণ করতে পারেনি, বিশ্ববিদ্যালয় তার লক্ষ্য থেকে সরে গেছে, সামগ্রিক রুচির পতন হয়েছে। এর দায়ভার ঐ পাকিস্তানি সেনাশাসকদের যে ক্ষতির কারনে দেশটা শতবছর পিছিয়ে গেলো। নতুন মেধা বাড়ার প্রক্রিয়াও স্থবির হলো। এখনো কিছু মানুষ মনে করে ঐ হানাদার ও তাদের দেশীয় দোসররা খুব বড় ক্ষতি করেনি। কিন্তু তারা ভাবে না বোঝে না, ক্ষতি জিনিসটা কি!
আমাদের জাতির মহান নায়কদের আমাদের ভুলে গেলে একদমই চলবে না। ঐ মানুষগুলোর আত্মত্যাগ, তাদের রক্ত যেনো বৃথা না যায় সেদিকে সচেতন থাকতে হবে। আর নিজের জাতিকে অপবাদ দেয়া বাদ দিতে হবে। দেশ আমাকে কি দিলো না সেটা কম হিসেব করে আমি কতখানি দিতে পারলাম সেটা হিসেব করতে হবে। দেশের টাকায় পড়ে বিদেশে থিতু হবার ইচ্ছাকে মূলোৎপাটন করতে হবে। যদি আমরা না করি এর দায়ভার আমাদের উপরই পতিত হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম প্রচন্ড ঘেন্না ভরে বলবে-
পূর্বপুরুষরা কাপুরুষ ছিলো!

আসুন ফের দেশকে গড়ি, ঐ মানুষগুলোর স্মৃতিকে নষ্ট না হতে দেই। আমার বাংলা অমর হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *